মোঃ মাহবুবুর রহমান
জীন আর ইনসান নিয়ে আমার কোন কালেই সন্দেহ ছিল না। তবে মৃত ব্যক্তির আত্মার শোধ-প্রতিশোধ কিংবা সহযোগিতা- অসহযোগিতা মেনে নেয়ার বিন্দু মাত্র তাগিদ হয়নি আমার মনে। এসব অশরীরীর কত গল্প উপন্যাসের কল্প কাহিনীতে পড়েছি। কখনও গা শিউরে উঠেছে ঠিকই। তবে তা কল্প কাহিনীর বেশী কিছু আমার মনে হয়নি কোন দিন। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতায় এ বিষয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের এক মোহনীয় দোলাচলে দুলছি আমি।
ভারত পৃথিবীর বিচিত্রতম এক দেশ। দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম শেষ না হলেও খুঁটি নাটি পারমাণবিক অস্ত্র সস্ত্র তারা তৈরি করে। সম্প্রতি মঙ্গলে মঙ্গলায়ন নামে যান দিয়ে স্বাক্ষর করেছে দেশটি। সমৃদ্ধ ইতিহাস আর দৃষ্টি নন্দন ঐতিহ্যও রয়েছে অনেক। ভারত ভ্রমণের আগ্রহ দীর্ঘ দিন থেকেই ছিল। হবে হবে করে হচ্ছিল না। গত মার্চ মাসে আর প্রতিকূলতার দিকে থোড়াই নজর দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভারতের কিয়দংশ দেখার জন্য। কিন্তু এবার হয়েও হল না। কারণ দীর্ঘ দিন ইউরোপে থাকার কারণেই বোধ হয় ভারতের হাওয়া আমার গায়ে আর সইল না। ডাক্তার তাই বললেন। বললেন- ‘’ লওয়ার রেস্পিরেটরি ইনফেকশন হয়ে গেছে।‘’ সেই ভারতের মাটি স্পর্শ করার পর থেকেই ভাইরাস জনিত জ্বর আর সর্দি -কাশি আমার গায়ে মেখেই রইল। যাচ্ছে যাচ্ছে করে থোড়াই গেল ! ইউরোপের ঠাণ্ডা আর ভারতের অগ্রসরমান গরমের মাঝখানে আমার ভারত দেখার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হল। এদিকে ডাক্তারের পরামর্শ মত বিশ্রাম নিতে গিয়ে আমার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হল। শুরু হল ফ্যাসাদের। উপমহাদেশের প্রশাসনিক হয়রানি আমি হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলাম। ভারতীয় অফিসারদের দৃষ্টি কটু অফিসার সুলভ চোখ রাঙ্গানি আমাকে পদে পদে যেন অপমানিত করল। কারো সহায়তা ছাড়া আর এগুতে পারছিলাম না। কিন্তু সহায়তা নেওয়ার মত লোক পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ পাশা নামের স্বল্প পরিচিত এক গপ্পবাজ বন্ধুর কথা মনে পড়ল। পাশা সেই লোক, যে কোন ভিন দেশের কথা উঠার সাথে সাথেই সে দেশে তার কোন না কোন আত্মীয় বা বন্ধুর গল্প সে ফেঁদে বসবে। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের থোড়াই সুযোগ বোঝে এ সব গল্প সে জুড়ে বসে। সফলতা প্রায় অসম্ভব মনে করেও ফোন দিলাম। বিপদের সময় মানুষ যেমন লতা গুল্মেরও সহায়তা নিতে কার্পণ্য করে না তেমনি এক প্রচেষ্টা বটে। ভেবেছিলাম ছলচাতুরি করে আমাকে এড়িয়ে যাবে। আসলে হল তার বিপরীত। ‘’কিছু পয়সা তো খরচ করাই লাগবে’’ বলে তুষার দা নামের এক লোকের নাম্বার দিল। ভাবলাম দালাল টালাল হবে হয়ত। তা হোক না! এখন এই গ্যাঁড়াকল থেকে উদ্ধার পাওয়াটাই মুখ্য। দুইবার ফোন দেওয়ার পর ওপার থেকে সাড়া না পেয়ে ভাবলাম এভাবেই তাহলে পাশা আমাকে ঠকিয়েছে ! ঘণ্টা সাতেক পরে বিকেলের দিকে আবার ফোন দিলে তুষার দা লোকটা ফোন ধরল বটে। বিস্তারিত বলার পর লোকটা রেগে গিয়ে আমাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। পাশাকেও এক হাত নিয়ে নিলেন। ভাবলাম আমার কাছ থেকে খরচা একটু বেশী নেয়ার ধান্দা হবে। লোকটা আমাকে এক রকম পাত্তাই দিলেন না। ব্যস্ত লোক হাতে এসব ফালতু কাজের সময় নেই এমন ভাব দেখিয়ে ফোন রেখে দিলেন। ভাবলাম এবার অন্য রাস্তা খোঁজে নিতে হবে। এ দিকে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় হোটেল ওয়ালা আমাকে হোটেলে রাখা না রাখার আইনি মার প্যাঁচ নিয়ে দ্বিধায় পড়লেন। আমার সফলতার ঘন ঘন খোঁজ নিতে লাগলেন। দুশ্চিন্তায় মাথার ওজন যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল। তুষার দা’র ব্যবহারে চটে গিয়ে দু’এক কথা শুনিয়ে দিতে মন চেয়েছিল বটে। কিছুটা আশা বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করে নিলাম। আর সেই নিভু নিভু আশাটা রাতেই দপ করে জ্বলে উঠল ! তুষার দা নিজ থেকেই ফোন দিলেন। কিছুটা অনুতপ্ত ও বোঝা গেল তার নরম সূরে। বললেন ‘’ কিছু মনে করবেন না, পাশা আমাকে এমন ভাবে বলল কিছু টাকা কামিয়ে নিয়েন। আমি তো দালাল না। বলেছিলাম দরকার হলে বল। বাংলাদেশে আমার পূর্ব পুরুষ ছিলেন। সে দেশের মানুষ এখানে আসলে প্রয়োজনে সহায়তা করা অভ্যেস আমার।‘’ আমার শুকিয়ে যাওয়া গলায় যেন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল অর্ধেক সমস্যাই সমাধান হয়ে গেল। উনি বললেন ‘’কাল সকাল ১০ টায় ‘’৮ বি’’ বাস স্ট্যান্ডে আসতে পারবেন ?’’ নিজ থেকে ফোন দেয়ায় বড় দালাল বলে যে ধারণা হয়েছিল তা আরও পোক্ত হল। তার পর দিন নিউ মার্কেট থেকে ট্যাক্সি করে ‘’৮ বি’’ বাস স্ট্যান্ডের পাশে হিন্দুস্থান সুইটস, জাদব পুর, কলকাতা। ভদ্র লোক ১০ টা বাজার কুড়ি মিনিট পরে এসে পৌঁছুলেন। কথা বার্তা হল। বড় দালাল বলে আমার যে ধারনাটা হয়েছিল কথা বার্তায় সেটা একেবারেই কেটে গেল। ভদ্র লোক মিউজিক কম্পোজার। গুণী লোক। ব্যস্ত না থাকাটাই অস্বাভাবিক। যাক, আমার সব শুনে বিজয় গড়ে আমার জন্য আলোক ধারা নামে ছোট্ট একটি ফ্লাট ভাড়া করে দিলেন। হোটেলের চেয়ে কিছুটা সাশ্রয়ী হলেও একই নিয়মে ভাড়া গুণতে হল আমাকে। শয়নের জন্য একটি আর বসার জন্য ছোট্ট একটি কক্ষের সাথে ছোট্ট করে রান্না ঘর ও গোসল খানা। শয়ন কক্ষে কিছু পুরনো বই তাকে সাজানো। চেস্ট অব ড্রয়ারের উপরে হারমনিয়াম এর সাথে তবলা আর ছোট্ট করে ধাতব মূর্তিতে রয়েছেন দেবী দুর্গা। তুষার দা আসতে আসতে সব দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কোথা থেকে খাবার কিনতে হবে আর কোথা থেকে পানীয় সহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিষ পত্র। রান্না ঘরটা বেশ অগোছালো ছিল। আমি সে দিকে খেয়াল দেইনি। কারণ তার দরকার ছিল না। বাসার মালিক কুণ্ডু সাহেব আসলেন সাথে তার স্ত্রী। কালো করে লম্বা ছিপছিপে চেহারা। সরকারি চাকুরে ছিলেন। মিসেস কুণ্ডু ও বেশ অমায়িক। এক কালে বাংলাদেশেই ছিলেন। ’৭১ সালে এপার থেকে ওপার গিয়ে বসতি গড়েছেন। তাই আমাকে আপন জনের মতই ভেবে নিয়েছিলেন। মিসেস কুণ্ডু বললেন ‘’ যখন যা দরকার মনে করবেন সাথে সাথে চলে আসবেন।‘’ মিঃ কুণ্ডুও তাতে সূর মেলালেন।
পরিচয় পর্ব শেষে তুষার দা’র সাথে বেরিয়ে গেলাম খাবার পানি আনতে। নীচে নামতেই দেখি টিয়া রঙের পাঞ্জাবিওয়ালা এক ভদ্র লোক ভর দুপুরে সেই কবে থেকে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ! যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম কারও জন্য অপেক্ষা করছেন মনে হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা থেকে একই স্থানে! অথচ একটু সরে দাঁড়ালে ছায়ায় থাকতে পারতেন। কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে। পানি কিনতে গিয়ে দোকানিকে জানতে চাইলাম ‘’পানি আছে, ৫ লিটারের জার?’’ কথাটি তিন বার বলার পরও তিনি বোঝতে পারলেন না। পরে বললাম ‘’ওয়াটার চাচ্ছিলাম।’’ তখনই উত্তর দিলেন ‘’ ও জল !’’ যাক ৫ লিটার জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখলাম সেই লোক একই স্থানে। ঘরে ঢুকে বেশ অবাক হলাম। ৩০/৪০ মিনিট সময়ের ব্যবধানে এত সুন্দর করে রান্না ঘর গোছানো! মিসেস কুণ্ডু করলেন কি! ভদ্র মহিলা জাদু জানেন নাকি! আমার ব্যাগ লাগেজ গুলো পর্যন্ত যথা স্থানে পৌঁছে গেছে ! যেন তুড়ি মেরেই সব করে ফেললেন! ভাবলাম দেখা হলে তাকে ধন্যবাদ জানাব।
সন্ধের দিকে বিজয় গড়ের গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। বেশ নিরিবিলি পরিবেশ। রাস্তা ঘাটে হই হুল্লুড় নেই। শুধু এ ঘর ও ঘর বেশ কয়েক জায়গা থেকে ঢোল করতালের ছন্দে পুঁজা অর্চনার ধ্বনি ভেসে আসছিল। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। যেন পূজা অর্চনার শব্দেই বাহিরের এই নিরবতা! গলির এখানে ওখানে রুটি সেঁকছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দেখতে বেশ লাগছিল। হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরি শেষে রাতের খাবার কিনে ঘরে ফিরলাম। বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নিয়ে এঁটো বাসন পত্র আর খাবারের পরিত্যাক্ত প্যাকেট টেবিলে রেখেই পরনের কাপড় চোপড় কোন মতে সোফায় ছুড়ে ফেলে বিছানায় গা এলাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমেই সকাল আটটা । বেশ গরম ছিল তাই উঠেই গোসল সেরে নিয়েই কাপড় বদল করতে গিয়েই চোখে চড়ক গাছ। সোফার উপর ছুড়ে ফেলা এলোমেলো কাপড়গুলো পরিপাটি করে চেস্ট অব ড্রয়ারের উপরে দেবী দুর্গার মূর্তির পাশে সাজানো ! বেশ অবাক হলাম। ভাবলাম- ‘’রাতে যতটুকু ক্লান্ত ছিলাম তাতে এভাবে পরিপাটি করার থোড়াই এনার্জি ছিল আমার! ভাবলাম ঘুম ঘুম চোখে করেছি হয়ত!’’ এবার জ্যাম পাউরুটি আর কলা নিয়ে খাবার টেবিলে বসতে গিয়ে দ্বিতীয় দফা আমার পিলে চমকে গেল। এঁটো বাসন পত্র আর পরিত্যাক্ত প্যাকেটের কোন চিহ্নই নেই ! সব ঝকঝকে ! অনেক চিন্তা করে হিসেব মিলাতে পারছিলাম না কিছুতেই। এর মধ্যে তুষার দা’র ফোন আসলে বেরিয়ে গেলাম কাগজ পত্র নিয়ে।
অফিসের টানা হেঁচড়ায় প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত ! সংশ্লিষ্ট অফিস বলে ‘’থানায় যান।‘’ সাব ইন্সপেকটার সাহেব ভাব নিয়ে বলেন- ‘’ বললেই কি হল! তদন্ত করতে হবে তো! বড় বাবুর কাছে যান।‘’ বড় বাবু রাশ ভারি কণ্ঠে বলেন- ‘’ না না না, এটা আমাদের অফিসের কম্ম নয়, আপনি আই, ভি ডিপার্টমেন্টে যান।‘’ আই, ভি তে গেলে বলেন- ‘’ উঁহু এটা আমাদের কাজ নয়। আপনি থানায় যান।‘’ নিজে না হয় কর্ম দোষে টম এন্ড জেরি খেললাম। কিন্তু ঘর্মাক্ত তুষার দা’র দিকে তাকাতে সংকোচ লাগছিল। বেচারা ডায়াবেটিকে আক্রান্ত। এ যুগে এমন নিঃস্বার্থ পরোপকারী পাওয়া ভার বটে। ভদ্র লোক বয়সে প্রায় ষাট বছরের হলেও চেহারায় চল্লিশের বেশী মনে হয় না। টম এন্ড জেরি খেলতে খেলতে দিনান্তে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছিলাম। বাসার নীচে আসতেই সেই টিয়া রঙের পাঞ্জাবিওয়ালা উদ্ভ্রান্ত লোকটার সাথে দেখা হল। সারাদিন দাঁড়িয়ে অপেক্ষার ডিউটি শেষে ফিরছিল লোকটা। কথা বলার অনেক আগ্রহ আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। ‘’ স্কিউজ মি’’ – বলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপই না করে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটা। প্রচণ্ড গরমে অনেকেই যখন স্বল্প বসনে ঘোরাঘুরি করছে আজব লোকটি তখন ফুল প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরিহিত! আসতে আসতে ভাবলাম পানির জারটা যদি ফ্রিজে রেখে যেতাম তাহলে এখন যথার্থ তৃষ্ণা নিবারণ করে সারাদিনের ক্লান্তিটা কিছুটা হলেও ঝেড়ে ফেলতে পারতাম। ঘরে প্রবেশ করে কাঁধের ব্যাগ রেখে টেবিলে তাকিয়ে দেখি পানির জারটাই নাই! ভাবলাম অন্য কোথাও তাড়াহুড়ো করে রেখে গেছি বোধ হয়। কিন্তু সারা ঘরের কোথাও নাই! প্রায় সাড়ে তিন লিটার পানি সমেত পুরো জার গায়েব! পানি কিনতে যাওয়ার মত শক্তি ও মনবল না থাকায় ফ্রিজে রাখা দইয়ের জন্য ফ্রিজ খুলতেই দেখি পানির জার ফ্রিজের ভিতর! ভাবলাম ‘’হচ্ছে কি এসব! আমার কি কোন অসুখ হল! কাজগুলো কি অবচেতন মনে আমিই করছি!’’ পানি বের করে এক গ্লাস পান করলাম। লিটার দেড়েক পান করার আর রুচি রইল না। সারাদিনের ক্লান্তির সাথে যোগ হল মাথা ধরা। এ ভাবে চলতেই থাকল। ঘরে নোংরা জামা কাপড় রেখে গেছি কিন্তু বাসায় ফিরে দেখি সাবান পানির সাথে কাপড় দিয়ে বালতি ভরতি করা! ধুয়ে শুকাতে দিয়ে গেলাম তো বাসায় ফিরে দেখি শুকনো কাপড় গুছিয়ে রাখা! এভাবে নিজেই নিজের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলাম পনেরটি দিন। তার পর ভাবলাম যে,- ‘’এ হতেই পারে না। এসব নিশ্চয় মিসেস কুণ্ডুর কাজ!’’ অপরাধ বোধে পুড়ছিলাম। অন্তত একবার তার সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ ছিল আমার!
অনেক দাপ্তরিক ঝক্কি পোহানোর পর ভিসা জটিলতা কাটিয়ে নিচ তলায় মিঃ ও মিসেস কুণ্ডুর কাছে বিদায় নিতে গেলাম। মিসেস কুণ্ডুকে এরকম ছোট খাট কাজের জন্য ধন্যবাদ দেব এমন সময় তিনি নিজ থেকেই বললেন – ‘’ দেখুন তো সেই যে আপনাকে চাবি দিয়ে আসলাম নানান ঝামেলার কারণে আর আপনার সাথে দেখাও করতে পারলাম না। তা কালকে বোধ হয় ভুল করে ফ্যান চালিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলেন? ডুপ্লিকেট চাবি না থাকায় আমি আর ঘরে প্রবেশ করতে পারিনি। আসলে প্রচণ্ড গরম তাই শর্ট সার্কিটের ভয় ছিল তো!‘’ পাল্টা জানতে চাইলাম- ‘’ তাই নাকি! ও হ্যাঁ হ্যাঁ।’’ পাল্টা প্রশ্ন করাটা আমার ভদ্রোচিত হয় নি তাই সাথে সাথে স্বীকার করে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলাম। মনে মনে বললাম- ‘’কিন্তু আমি তো ফ্যান বন্ধই পেলাম!’’ ঘামতে শুরু করলাম আমি। ভাবলাম – ‘’তাহলে এসব কি হচ্ছিল ! আমি তো বাইরে এমন ভুল করলাম না! শুধু ঘরেই কেন কাজ করে ভুলে যাব!’’ ঘরে ফিরে এলাম। এই প্রথমবার ছোট্ট ঘরটাকে শুনশান বিশাল মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। তাই ঘরের প্রতিটি কোণে সতর্ক দৃষ্টি দিতে লাগলাম। কিন্তু রান্না ঘরের জানালার কাঁচ ভাঙ্গা। সে দিকে তাকাতে পারলাম না। কারণ জানালার পাশে কি যেন একটা পুরনো গাছ রয়েছে। মন থেকে ছায়াতঙ্ককে দূর করার জোর প্রচেষ্টা চালালাম।
রাতের খাবার শেষে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। ছায়াতঙ্ক আর পরদিন ভোরে ফ্লাইট মিস না করার সতর্কতায় ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল। এর মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় হটাৎ এক শব্দ শুনে আমার গা হিম হয়ে এল। নূপুর পায়ে কে যেন হাঁটছে! ছোট্ট ঘর তাই দু’ এক পদক্ষেপের বেশী এক সাথে শোনা যাচ্ছিল না। আতঙ্কে মুখে বালিশ চেপে শুয়ে আছি। কোন শব্দ করার সাহস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল অন্ধকারের মাঝে চেস্ট অব ড্রয়ারের উপরে থাকা দুর্গা মূর্তি জীবন্ত হয়ে আমার শয্যা পাশে হাঁসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মহান আল্লাহ্র বাণী যা মুখস্ত ছিল মনে মনে পড়ে যাচ্ছিলাম। তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছিল। জ্বরে গা কাঁপছিল। হয়ত মূর্ছাই গেলাম। পরদিন ভোরে তুষার দা এসে ডাকলেন। উঠে দরজা খোলে দিলাম। তারপর ঝটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সিকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম। ট্যাক্সি চেপে বসেই পেছন ফিরে তাকালাম। কেমন যেন এলাকাটার সাথে একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। বাসার সামনে ছোট্ট করে একটি পার্কের যে গাছটার নীচে টিয়া রঙের পাঞ্জাবিওয়ালা লোকটা দাঁড়ায় সে জায়গাটা তখনও ফাঁকা। লোকটা আসার সময় হয়নি। উদ্ভ্রান্ত সেই লোকটার মনের কথা আমার শোনা হল না। কিসের না জানি কত ব্যাথা লোকটার মনে রয়েছে। তুষার দা প্রশ্ন করলেন – ‘’ এলাকাটা নিরিবিলি না!’’ বললাম- ‘’হ্যাঁ, এলাকাটাকে আমার হৃদয়ে রেখে দিয়েছি দাদা।‘’ তুষার দা বললেন- ‘’ বেশ তো, আবার এসো। তুষার দা যতদিন আছি তোমার চিন্তা নাই কোন।‘’ আমার সাথে তুষার দা’র সম্পর্ক আপনি দিয়ে শুরু হলেও তুমিতে আসতে দেরি হয়নি।
ট্যাক্সি এগিয়ে যাচ্ছে। অবচেতন মনেই হঠাৎ তুষার দা’কে প্রশ্ন করে বসলাম- ‘’ দাদা টিয়া রঙের পাঞ্জাবিওয়ালা ঐ উদ্ভ্রান্ত লোকটাকে চেনেন? ঐ যে প্রখর রোদে বাসার সামনে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে।‘’ তুষার দা বললেন- ‘’ ও নিতেন! সে এক লম্বা কাহিনী।‘’ আমি নড়ে চড়ে বসলাম। তুষার দা বলে চললেন- ‘’ দু’গলি পরেই বাসা। মন প্রাণ দিয়ে ভাল বেসেছিল ব্রাহ্মণের মেয়ে শোভাকে। তুমি তো জানো আমাদের সমাজে জাত ভেদ খুবই তীব্র। তা ভালবাসার সম্পর্ক কি সেই ভেদাভেদ তোয়াক্কা করে!’’ প্রশ্ন করলাম- ‘’ তারপর কি হল দাদা!’’ তুষার দা বললেন- ‘’ যা হওয়ার তাই হল! শোভা ছিল যেমন সুন্দর, সুহাসিনী তেমনি ছিল উঁচু জাতের মেয়ে। নিতেনের সাথে ব্রাহ্মণের জাত ভেদ সমাজ মেনে নেয়নি। কিন্তু নিতেনের আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল ছিল। শোভাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু ভালবাসার বিষয়ে দু’জনেই বেপরোয়া ছিল। দু’জনেই পালিয়ে যেতে চেয়েছিল।‘’ এই পর্যন্ত বলে তুষার দা থেমে গেলেন। আমার আর তর সইছিল না। জিজ্ঞেস করলাম- ‘’তার পর কি হল দাদা?’’ তুষার দা আবার বলতে লাগলেন- ‘’ পালিয়ে যাওয়ার দিন নিতেন টিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরে অপেক্ষা করছিল। শোভারও একই রঙের শাড়ি পরার কথা ছিল। কিন্তু শোভার যে বান্ধবি সারদা তাকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল সেই সারদারই শেষতক জাত চেতনা জেগে ওঠে। তাই সে পরিকল্পনাটা শোভার বাবার কাছে ফাঁস করে দেয়। শোভার দরিদ্র বাবা ঐদিনই ভাল লগ্ন দেখে জাত রক্ষার্থে জোর করে শোভাকে একটা বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ঐ দিনই অপেক্ষা করতে করতে নিতেন উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে যায়।‘’ আমি বললাম- ‘’ ও, আর সেই দিন থেকেই নিতেন টিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরে শোভার জন্য অপেক্ষা করে!’’ তুষার দা বললেন- ‘’হ্যাঁ। দুঃখের বিষয় কি জানো! শোভার সেই বয়স্ক স্বামীটা ছিল একটা হীন মনের লোক। শোভা ছিল খুবই অথিতি পরায়ণ, ও অথিতিকে হাঁসি মুখেই খাতিরদারি করত। শোভার এই গুণটা তার খুব অপছন্দের ছিল।‘’ আমি আবার বললাম- ‘’ তাহলে শোভা আসে পাশে কোথাও থাকে!’’ তুষার দা বললেন- ‘’ থাকে না, থাকত। রহস্যজনক ভাবে গৃহবন্দি অবস্থায় সে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। অনেকের ধারণা মারা যাওয়ার পরেই তাকে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট করানো হয়েছে।‘’ ওহ! খুবই বেদনাদায়ক। সত্যিই উদ্ভ্রান্ত লোকটার বুকে ভরা রয়েছে একটি সুন্দর জীবনের পুড়ে যাওয়া ছাই ভস্ম! তুষার দা আবারও বললেন- ‘’ জানো কোন ঘরে সে থাকত?’’ পাল্টা প্রশ্ন করলাম- ‘’কোন ঘরে?’’ তুষার দা উত্তর দিলেন – ‘’ তুমি যে ঘরে ছিলে।‘’ কথাটা শুনেই আমি ট্যাক্সির খালি আসনগুলো পলকে দেখে নিলাম। অবচেতন মনেই মনে হল সে হয়ত আমার সাথে ট্যাক্সিতেই রয়েছে। কিন্তু ডান দিকে তাকাতেই আমার হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড়! লাফ দিয়ে ট্যাক্সির বাঁ প্রান্তে উড়ে গিয়ে পড়লাম। আমার ডানে বসা তুষার দা চমকে উঠে বললেন- ‘’কি হল!’’ সামলে নিয়ে হাঁসার বৃথা চেষ্টা করে বললাম – ‘’ টিয়া রঙের পাঞ্জাবীতে আপনাকে দারুণ লাগছে!’’