ভ্রমণ- রাশিয়া থেকে ফিরে

এনাম আহমেদ

গোধুলী লগ্ন। আলো আধারির খেলা চলা মায়াবী অদ্ভূত সময়। মস্কোর বুক চিরে বয়ে চলা মস্কোভা নদীকে পেছনে ফেলে আমরা পা রাখলাম ইতিহাস খ্যাত রেড স্কোয়ারে। রেড স্কোয়ার হল বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর। লক্ষ লক্ষ লাল ইট বিছানো থাকায় পুরো অঞ্চলটিই ছিল লাল। এজন্য এটি রেড স্কোয়ার। সেভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়ার পুঁজিবাদি সরকারগুলো আবারও ‘লাল’ এর উত্থানের আশংকায় লাল ইটের উপর কালো রঙের প্রলেপ দিয়ে দিয়েছে। ‘লাল’ কে এতো ভয়? রেড স্কোয়ারের বাম পার্শ্বে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ক্রেমলিন। ক্রেমলিনকে বলা হয় হার্ট অফ মস্কো। ক্রেমলিন শব্দটি এসেছে ক্রেমলি-লজি শব্দ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে রাশান ও সেভিয়েত পলিটিক্স। এটি এখনও রুশ প্রেসিডেন্টের অফিসিয়াল বাসভবন। মহাকাশের প্রথম মহিলা অভিযাত্রী রাশিয়ার ইউরি গ্রেগারিন সহ বিখ্যাত রাশানদের সমাধি রয়েছে ক্রেমলিনে। ক্রেমলিন সংলগ্ন একটি আলাদা একতলা ভবন, সেটিও লাল ইটের তৈরী। এই ভবনে লেলিনের মরদেহ মমি করে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা আর সে ভবনে ঢুকতে পারলাম না। তার পাশে বহুতল বিশিষ্ট লেলিন মিউজিয়াম। উল্টো দিকে সেন্ট ব্রেসিলস কগথ্রিড্রেল। এর অপূর্ব নির্মাণ শৈলী ও চোখ ধাঁধানো কারুকাজের জন্য এটিই মস্কোর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সামনে মস্কোর প্রাচীন শপিং মল। আসলে মস্কোর প্রায় প্রতিটি ভবনেরই আলাদা আলাদা নির্মাণ শৈলী রয়েছে। তখন সন্ধ্যা পেড়িয়ে মস্কোর ভয়াবহ শীতের রাত। আমরা স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে প্রচুর ছবি তুললাম। আকাশে আলো আধারির খেলা চলায় ছবিগুলোও খুব সুন্দর হল। সামান্য এগিয়ে বাম পার্শ্বে ২য় বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের শিখা চিরন্তন এর কায়দায়। এর চারধারে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল প্রহরারত। যা কিনা সেভিয়েত আমলে লেলিন সমাধির সামনে ছিল। এখন লেলিন সমাধিকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য তা সরিয়ে অগ্নিশিখার সামনে নেয়া হয়েছে। নিকটবর্তী স্থানে টাইম স্কোয়ার। মস্কোর এই স্থানকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সময় গণনা করা হয়। এই সময়ও ভয়াবহ সময়। রাশিয়া ১১টি সময় অঞ্চলে বিভক্ত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হওয়ায় একই দেশে কোন স্থানে দুপুর, কোন স্থানে রাত। এর কাছাকাছি স্থানে তারা শুরু করেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ক্রাউন ডাউন। এবার ফুটবল বিশ্বকাপ হচ্ছে রাশিয়ায়। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে আমাদের দেখানো বিশ্বকাপ শুরু হতে আর মাত্র ২৬০ দিন বাকী। ক্রেমলিনের কাছাকাছি ঐতিহাসিক মস্কোর ঘন্টা। এটি চীনের প্রাচীর ও তাজমহলের সাথে প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্যের একটি। শীতে আর টিকতে না পেরে, রাতও বেশী হয়ে যাওয়ায় সবাই কে গাড়িতে ফিরে আসতেই হল। অদ্ভূত  এক আমেজ নিয়ে রেড স্কোয়ার থেকে ফিরছি আমরা। চারিদিকে ঝলমলে মস্কো। তবে লন্ডনের মতো কৃত্তিমতার বাড়াবাড়ি নেই। লোক দেখানো জৌলুষের আধিক্য নেই। আবারও এক ঘন্টা জার্নির পর আমাদের গাড়িটি এসে থামল একটি জায়গায়। এলাকাটি খুব ব্যস্ত নয়। কিন্তু সাইনবোর্ডে চোখে পড়ল। একটি অক্ষরও ইংরেজীতে নেই। সুতরাং স্থানটির নাম জানা গেল না। আমরা ১২জন নেমে ঢুকলাম একটি আবাসিক হোটেলে। জালাল ভাই সহ সিনিয়র দশ জনের ব্যবস্থা করা হল অন্য হোটেলে। হোটেল ক্যাম্পাসের ভিতরে বেশ কিছু উন্মুক্ত ফাঁকা জায়গা। এর চারিদিকে বিভিন্ন স্থাপনা। একটি বন্য বিড়ালকে ইস্তস্থত: বিক্ষিপ্তভাবে ঢ়ুরাঘুরি করতে দেখা গেল। শীতের দেশ বলেই হয়তো লোমগুলো অপেক্ষাকৃত লম্বা। বিড়ালকে দেখে এশিয় আমেজ পেলাম। ইংল্যান্ডে মুক্ত বিড়ালের দেখা পাওয়া অসম্ভব। হোটেলের একটি অংশে জিমনেশিয়াম। অনেক নারী পুরুষকে জিম করতে দেখলাম। রাশান’রা অনেক বেশী স্বাস্থ্য সচেতন। এটি তাদের ফিগার           
দেখল্ েবুঝা যায়। গাইড আমাদের ১২জনকে হোটেল লবিতে বসিয়ে বাকী ১০ জনকে অন্য হোটেলে রেখে আসতে বের হয়ে গেলেন। আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে এসে এই হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন। রেড স্কোয়ার আমাদের খিদে ভুলিয়ে দিলেও হোটেল লবিতে সবাই খিদেয় হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। এটি যাদের প্রথম ইউরোপ সফর, তারা ওয়াশ রুমে গিয়ে নিদারুন বিভ্রান্তিতে পড়ল। ইউরোপে আজ পর্যন্ত কোন উপমহাদেশীয় মানুষ ওয়াশ রুম থেকে সম্মান নিয়ে বের হতে পারেননি। ভুক্তভোগীরা এতক্ষণে বিষয়টি বুঝে গেছেন। ‘ত্যাগেই মুক্তি’ এই নীতি বাক্য বারবার আউড়িয়েও খিদে থেকে মুক্তি পেলাম না। এদিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ এক বর্ণও ইংরেজী বুঝে না। সুমন হাত নেড়ে নেড়ে বুঝানোর চেষ্টা করল যে আমাদের রুমে ঢুকতে দাও, আমরা ক্লান্ত। ফ্রেস হওয়া জরুরী। আমাদের গাইড এসে টাকা দেবে, রেজিস্ট্রেশন করাবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সুমনের কোন ইশারাই বুঝেন না। উপরন্তু সুমনের হাত নাড়াচাড়াকে ভারতীয় নৃত্যের অনুসঙ্গ মনে করে হাততালি দিয়ে দিল। সুমনের হাতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলেও তার বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পারল। আমাদের জন্য কফির ব্যবস্থা করলেন। একজন হোটেল স্টাফ আমাদের ম্যাজিক দেখালেন। আমরা ক্লান্ত দেহে হোটেল লবিতে বসে এ পর্যায়ে তাদের আদর যতেœ অতিষ্ট হলাম। রাশান ম্যাজিকের পাল্টা হিসেবে আমরা তাদের বাংলাদেশী গণসংগীত গেয়ে শুনালাম। অবশেষে আমাদের গাইড উদয় হল। দ্রুত আমাদের সদগতি হল। গাইডের নেতৃত্বে খাওয়া দাওয়া করার পর থাকার রুমটি দেখিয়ে দিলেন। রুমের ভিতরে ঢুকেই থমকে গেলাম। মাঝারি সাইজের রুম। তিনটি করে দু’তলা খাট। আমার সিট পড়েছে একটি খাটের ২য় তলায়। বাকী বোর্ডাররা বেশী সাদা ও বেশী কালো। বোর্ডারদের মধ্যে জাতিতে ধর্মে, বর্ণে এমনকি……তে কোন ভেদাভেদ এই ! পরিস্থিতি আমাদের প্রাচ্যদেশীয় মন মানসিকতা রীতিমতো আঁতকে উঠার জোগাড়। সিঁড়ি বেয়ে খাটের চূড়ায় উর্দ্ধে উঠে দিলাম এক ঘুম। সেই ঘুমের জন্য আমাদের পরবর্তীতে চরম মূল্য দিতে হয়েছে., (লেখকের  রাশিয়া থেকে ফিরে ভ্রমন কাহিনীর একাংশ

আপনার মতামত দিন
শেয়ার করুন