সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ হোসেন খসরু

 বিপ্রদাস ভট্টাচার্য্য

প্রকৃত সংগীত মানুষকে রূপে রসে ছন্দে সুষমামন্ডিত করে তোলে। সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই মানব জীবনে সংগীতের প্রভাব লক্ষণীয়। সংগীত জগতে একটি অবিস্মরণীয় নাম ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু। অনেকে ওস্তাদ হোসেন খসরু নামে তাঁকে অভিহিত করে থাকেন।

এই বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ হোসেন খসরুর জন্য ১৯০০ সালে কুমিল্লায়। পিতা জায়েদুল হাসান এবং মাতা আফিয়া খাতুন ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ ঘরের মানুষ। এরকম একজন সংগীত প্রতিভার জন্য হবে, তাঁরা ভাবতেও পারেন নি। শিশু খসরু বড় হয়ে সংগীত জগতে অমরত্বের আসনে বসবেন কেউ কল্পনাও করেনি। সে সময় সংগীতের প্রচার এবং প্রসার খুব অল্প। সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করার ও সুযোগ ছিলনা। তাছাড়া গ্রাম্য পরিবেশ আর সমাজের বাধা বিপত্তি অনেকটা সমস্যায় ফেলেছিল মোহাম্মদ হোসেন খসরুকে তখন গান শেখার প্রধান মাধ্যম ছিল রেডিও। সেই রেডিও শুনে শুনেই গুণ গুণ করে হোসেন খসরু সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। কৈশোর কাল কুমিল্লায় কাটিয়ে ছুটে গেলেন কলকাতায়।

কলকাতায় এসে মোহাম্মन হোসেন খসরুর সংগীত জীবনের শুভ সূচনা হয়। কলকাতার বিখ্যাত ওস্তাদ মেহেদী হোসেন খাঁর কাছে তিনি তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ মেহেদী হোসেন ছিলেন গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদ হবার বংশ পতিকা। ওস্তাদ হস্যু খাঁ নথু খাঁ, নিসার হোসেন এবং ওস্তাদ মেহেদী হোসেন ছিলেন গোয়ালিয়র ঘরানার কর্ণধার। মোহাম্মদ হোসেন খসরু স্বাভাবিক ভাবেই গোয়ালিয়র ঘরানার শিষ্যত্ব লাভ করেন। গুপ্তাদ মেহেদী হোসেনের শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- বলনেওজী, বালকৃষ্ণ বুয়া, বাসুদেব যোগী, মোহাম্মদ হোসেন খসরু। গোয়ালিয়র ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধ্রুপদ অঙ্গের খেয়াল, বোলতানের নানা ছন্দ, লয়কারী, গমকের প্রাধান্য, বিস্তারের কুশলতা, সপাট তান, খেয়ালের শেষ পর্যায়ে তারানা গায়ন ইত্যাদি। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু এসব বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। গোয়ালিওর, বরোদা এবং লক্ষ্ণৌ এই তিন রাজ্যেই প্রায় একই গায়ন শৈলীর প্রচার ঘটতে থাকে।

সে সময় ওস্তাদ হোসেন খসরু লক্ষ্ণৌর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তবে কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর শিষ্য ওস্তাদ শরাফত হোসেন, লতাফত হোসেন খাঁ, নীলিপচন্দ্র বেদী, আতা হোসেন প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসেন। পাতিয়ালা ঘরানার প্রবর্তক ওস্তাদ বড়ে মিঞা কালেখার সুযোগ্য উত্তরসুরী গোলাম আলী খাঁ সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু তখন খেয়াদের পাশাপাশি ঠুমরীর প্রতি ও সমানভাবে আকৃষ্ট হতে থাকেন। এভাবে তিনি, খেয়াল, ঠুমরী, ধ্রুপদ, টপ্পা গানে পারদর্শীতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে কলকাতা ছেড়ে মোহাম্মদ হোসেন খসরু পাড়ি দেন লক্ষ্ণৌ। সেখানে মরিস কলেজ (ভাতখণ্ডে সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৩১ সালে তিনি লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত মরিস কলেজ ও মিউজিক বিভাগে সহকারী অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। মাত্র কয়েক বছর থেকে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় একটি সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। উচ্চাংগ সংগীতে যথেষ্ট দক্ষতার দরুন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু নিখিল ভারত সংগীত সম্মেলন ও নিখিল বঙ্গ সম্মেলনে বিচারকের আসন অলংকৃত করেন। ১৯৯৩ সালে ইষ্ট বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে তাঁকে ওস্তাদ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী। উচ্চাংগ সংগীতের পাশাপাশি যন্ত্র সংগীতেও তাঁর দক্ষতার পরিচয় মেলে। পাশাপাশি তিনি নৃত্য বিষয়েও পারদর্শী ছিলেন। সংগীতের পাশাপাশি অনেকে নত্য পাঠ গ্রহণ করেছেন তাঁর কাছে। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু কিছু নজরুল সংগীতের সুরারোপ করেন। তিনি কয়েকটি নজরুল সংগীতের রেকর্ড করেন। ১৯৪৭ এর পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। পাক ভারত উপমহাদেশে তিনি অনেক শিষ্য রেখে গেছেন। ১৯৫৯ সালে এই প্রতিভাবান সংগীতজ্ঞের জীবনাবসান ঘটে । ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু সংগীতের ইতিহাসে আজ অমর হয়ে আছেন।

(লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাতায়ন পাউন্ডে সিলেট কেন্দ্রীয় সাহিত্য সাংস্কৃতিক ফোরাম, অধ্যক্ষ, ললিত কলা একাডেমি, আইনজীবি।)

আপনার মতামত দিন
শেয়ার করুন